"মনুষ্যত্ব বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা"

আপলোড সময় : ১৬-০৫-২০২৩ ০৯:২৬:৫৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ১৬-০৫-২০২৩ ০৯:৩২:৩৮ পূর্বাহ্ন
যে কোনো জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জনের জন্য মানবসম্পদের উন্নতি বিধান অত্যন্ত জরুরি। মানব উন্নয়ন মানে ব্যক্তি মানুষকে মননে-মেধায় এবং দক্ষতার দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট করে গড়ে তোলা।

দক্ষ ও যোগ্য মানুষ সেই হতে পারে, যার মন বিকশিত; সুপ্ত মেধাকে যে কাজে লাগিয়ে নিজের এবং অপরের কল্যাণ সাধনে ব্রত হয়। যদিও একজন মানুষ প্রথমে তাঁর পরিবার, সমাজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মানবীয় নীতিগুণ ও মনুষ্যত্বসমৃদ্ধ মানসিকতা বিকাশের জন্য সৃজনশীল বই-পুস্তক যে কতটা অপরিহার্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নানা বিষয়ে পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে মানব জীবনের জমিন কর্ষিত হয়, কিন্তু সেই জমিনে ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজন আরও জ্ঞান; আরও পড়াশোনা-জানাশোনা তথা অব্যাহত পাঠ প্রক্রিয়া, যা থেকে যে কেউ ইচ্ছা অনুসারে উন্নত হতে পারে অনায়াসে।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নতুন নতুন জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জনে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। যার সহজ ও অনন্য মাধ্যম হলো বই। একটি বই একটি ভালো বন্ধু। একটি বই একটি সুন্দর সময় উপহার দেয়। জ্ঞানের আলো বিলায়। অবসরে সঙ্গ দেয়।

সুস্থ মন ও মনন, চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটায়। একটি ভালো বই থেকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার সবক পাওয়া যায়। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, নিঃসন্দেহে বই মানুষের জ্ঞান অর্জনের ধারাটিকে বেগবান এবং প্রায়োগিক পরিপূর্ণতায় শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলে।

আর সে ক্ষেত্রে পাঠক সৃষ্টিতে পাঠাগারের ভূমিকা বিরাট। এই উপমহাদেশে পাঠাগার বা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রন্থাগার চর্চার ইতিহাস বহু পুরোনো বলা চলে ঐতিহাসিক। মোগল আমলে এবং তার আগেও প্রাসাদকেন্দ্রিক ছিল গ্রন্থাগার। ব্রিটিশ শাসনামলে অভিজাত শ্রেণির অনেকের বাড়িতে ছিল পারিবারিক গ্রন্থাগার।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্থানে স্থানে গণগ্রন্থাগার স্থাপনে বিভিন্ন মহলের উদ্যোগী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। পঞ্চাশ-ষাট এমনকি সত্তর দশকেও আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য গ্রন্থাগার ছিল। এখন আমাদের দেশে অনেক গ্রন্থাগার আছে।

কিন্তু এসব গ্রন্থাগারের চর্চা উল্লেখ্যযোগ্য নয়। আজকাল শিক্ষকদেরও গ্রন্থাগার চর্চায় ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ প্রদান করতে তেমন দেখা যায় না। অতীতে শহরাঞ্চলের পাড়ায়-মহল্লায় এমনকি গ্রামগুলোতেও শিক্ষিত লোকেরা মিলে গ্রন্থাগার গড়ে তুলতেন।

এ ক্ষেত্রে তরুণরাই পালন করতেন অগ্রণী ভূমিকা। স্বল্পশিক্ষিত গৃহবধূ, মা-বোনেরাও পাড়ার গ্রন্থাগার থেকে লোকজনের সহায়তায় বই পাঠ করতেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির নামে আধুনিক ও বিলাসী হয়ে পাঠচর্চা তথা গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির প্রতি মনোযোগ হারাতে বসেছি আমরা!

অথচ শিক্ষার্জন, জ্ঞান অন্বেষণ ও বিদ্যা লাভ, মনের খোরাক জোগানো কিংবা অবসরের অতুলনীয় সঙ্গী হিসেবে বই তথা পাঠাগার আমাদের প্রয়োজনের এক অপরিহার্য সামগ্রী। তবে তিক্ত বাস্তবতা হলো, তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে তরুণ প্রজন্ম বইপ্রেম ও বইয়ের শিক্ষা গ্রহণে চরম উদাসীন হয়ে পড়েছে।

ডিভাইসনির্ভর জ্ঞান লাভে তারা তৎপর হয়ে উঠলেও বিবিধ কারণে তা থেকে প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান লাভ জটিলই বটে। বরং বলা যায় লাবের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। সেকালে ওমর খৈয়াম, একালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবিসহ বহু মনীষী বইয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে গুরুত্বারোপ করেছেন।

অথচ আমাদের দেশে বই ও পাঠাগার নিয়ে ফলপ্রসূ কার্যক্রম তেমন নেই বললেই চলে। আজকাল দেখা যায়, অধিকাংশ তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী যৎসামান্য উপন্যাস, গল্প, কবিতা, থ্রিলার এর মধ্যেই তাদের পাঠ সীমাবদ্ধ। তারা পাঠ্যপুস্তকের বাড়তি কোনো বই পড়তে চায় না।

যে কারণে তাদের জ্ঞানও থাকে সীমাবদ্ধ। আমাদের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে হলে অবশ্যই উঁচু মানের বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে হবে। ইতিহাস দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, চলমান ঘটনা, বিশ্ব পরিস্থিতি, শিল্প-সংস্কৃতি মহামানবদের জীবন কাহিনি, তাসাউফ দর্শনসহ বিষয়ভিত্তক ধর্মীয় নানান বই পাঠ করতে হবে।

আদর্শিক ও ধর্মীয় বই পাঠের মধ্য দিয়ে আদর্শ চরিত্র ও উন্নত নৈতিকতা অর্জন করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিকে উপলব্ধি করেই যুগে যুগে কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বই আদান-প্রদান তথা প্রতিষ্ঠা করেছেন পাঠাগার।

পাঠাগার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরব দার্শনিক-ইবনে খালদুন পাঠাগারশূন্য রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনের প্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবে অভিহিত করেছেন। দার্শনিক হেগেল মন্তব্য করেছেন, ‘পাঠাগারের মাধ্যমেই জনসমাজ যখন রাষ্ট্রীয় সমাজে রূপান্তরিত হয়, তখনই সে সাবালকত্ব অর্জন করে এবং বিশ্ব সমাজের অংশ হয়ে দাড়াঁয়।’

এঙ্গেলস-এর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হলো- ‘পাঠাগারশূন্য রাষ্ট্র যেন শুকিয়ে মরার মতো।’ সুতরাং সৃজনশীল পুস্তক সমৃদ্ধ পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা দায়িত্বশীলরা কখনোই এড়িয়ে চলতে পারেন না। আজকাল সমাজে যারা অতিবুদ্ধিমান বা সচেতন বলে নিজেদের দাবি করেন,

তারা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কতটা ভাবেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের মনে হয়, সমাজের বিত্তবান বা সৃষ্টিশীল মানুষগুলো যদি ইচ্ছা করে, তাহলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে সৃজনশীল বইয়ের পাঠক সৃষ্টি তথা তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ বইয়ের সমাহারে অসংখ্য পাঠাগার গড়ে তোলা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আমরা বিশ্বাস করি, বই পাঠের মাধ্যমেই দূর হবে অন্ধকার, কুসংস্কার, হিংসা-প্রতিহিংসা, অরাজকতা সর্বোপরি যাবতীয় সামাজিক অবক্ষয়। শহরে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন পাঠাগার আছে। ঢাকার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পাশে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠাগারে ধর্মীয় বই-পুস্তক বিপুল পরিমাণে মজুত আছে।

সুফিয়া কামাল ন্যাশনাল পাবলিক লাইব্রেরিতে আছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর বই। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে ছাত্র পাঠাগার। দেশের উল্লেখযোগ্য কওমি মাদ্রাসাগুলোতে আছে ধর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, মতবাদ ও রাজনীতিবিষয়ক বইয়ের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।

অনেক আলেম বা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও সমৃদ্ধ। এসব গ্রন্থাগার যুগে যুগে গড়ে উঠেছে বিশ্বকে ও বিশ্বের স্রষ্টাকে জানার প্রবল আগ্রহ থেকে। মনুষ্যত্ব বিকাশের তৃষ্ণাতুর মানসিকতা থেকে, যা একজন প্রকৃত ও আলোকিত মানুষের জন্য অতীব জরুরি।

লেখক : মো.আলী আশরাফ খান
কবি ও সামাজিক সংগঠক।

পিকে/এসপি

সম্পাদকীয় :

প্রধান সম্পাদক : মোঃ মাকসুদেল হোসেন খান

সম্পাদক : মো. শরীফুল ইসলাম (শরীফ প্রধান)

যোগাযোগ : 01675785122

ই-মেইল : [email protected]

অফিস :

ঢাকা অফিস : হাউজ#৬, রোড#০৩, ব্লক#জে, বারিধারা ঢাকা-১২২৯।

কুমিল্লা অফিস : কদমতলী সুপার মার্কেট (ভূমি অফিস সংলগ্ন), বলদাখাল রোড, দাউদকান্দি পৌর বাজার, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।

ওয়েবসাইট : www.prodhankhabor.com