কাজী এনামুল হক: ১৯৪৮ সনের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ও পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ওই প্রস্তাবের পর ঝড় বয়ে যায় গণপরিষদে। যার ফল হল : রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন। একুশ মানে আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক।
একুশের চেতনা মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে। অবিচার, অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দূর্জেয় প্রতিরোধ গড়ে তুলার নাম একুশ। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের জাতি সত্ত¡ার শ্রেষ্ঠতম পরিচয় বহন করে। এই একুশের গোড়ায় যিনি, তিনি বৃহত্তর কুমিল্লার কৃতিসন্তান, আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার স্থপতি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপনকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র কুমিল্লার বাড়িটি অযত্ন অবহেলায়,একপাশে টিনের ঘরে চা দোকানআর সেই সময়ের ঘরটি ময়লা আর্বজনায় চা দোকানীর পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। যথাযথভাবে সংরক্ষণ, তত্ত্বাবধান ও একটি আন্তজার্তিক মানের ভাষা যাদুঘর স্থাপনের দাবী কুমিল্লার মানুষের দীর্ঘদিনের।
লেখক, সাংবাদিক আবুল কাশে, হৃদয় বলেন-বাংলা ভাষার কলকাকলীতে মুখরিত অঞ্চল ঢাকা কিংবা কলকাতায় নয়, খোদ পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচিতে গিয়ে যিনি সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাকে পাকিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার বক্তব্যে বলেছিলেন, এই প্রস্তাব প্রাদেশিকতা মনোভাব প্রসূত নয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছয় কোটি ৯০ লাখ, তার মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখই বাংলা ভাষাভাষী। সে যৌক্তিক ভিত্তির উপরই তিনি তার প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। তখন তিনি আরও বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথিত বা ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সে বিবেচনায় বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’‘পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮) তৎকালীন কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ও পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি পেশ করেন।
ধীন্দ্রেনাথ দত্ত নিয়মিত কার্যবিধির ২৮ ধারার উপর একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজীর পর ‘অথবা বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করার যৌক্তিক দাবী করেন। গণপরিষদে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে বক্তব্য রেখেছিলেন তার কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
I know, sir, that bengali is a provincial language, but, so far our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing. Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this state, four crores and forty lakhs of people speak the bengali language. So,
sir what should be the state language of the state Pakistan? The state language of the state should be the state language which is used by the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that bengali language is lingo franca of our state.... So we are to consider that in our state it is found that the majority of the people of the state do speak the bengali language then bengali should have an honored place even in the central government.
লেখক মোতাহের হোসেন মাহাবুব বলেন- শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর পরিবারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় স্মৃতি রক্ষায় বাড়িটি সংরক্ষণ করা যাচ্ছেনা। ১৯৫০ সালে গনপরিষদে আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এরও তীব্র প্রতিবাদ করেন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী সারা পৃথিবীর মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মাতৃভাষার জন্য চরম ত্যাগের মুহুর্তটিতে বাঙলার দামাল ছেলেরা অকাতরে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সৃষ্টিকরে মাতৃভাষা রক্ষার ইতিহাস। আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে বাঙালীর মাথা উচুঁ করে দাড়াবার ইতিহাস সৃষ্টি হয় তখন থেকেই। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রæয়ারী এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তৎকালীন গণ পরিষদ সদস্য শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
৫২’র সেই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১’এ আমাদের মহান মুক্তিয্দ্ধু ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ অর্জনের জন্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে শুধু গণপরিষদে কিংবা রাজপথে আন্দোলন নয়: একাধিকবার কারা বরণ সহ ১৯৭১’এ যুদ্ধ চলাকালে কনিষ্ঠপুত্র শহীদ দীলিপ দত্ত সহ কুমিল্লা নগরের ঝাউতলা বাসা থেকে ২৯ মার্চ রাত দু’টোয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং পরে কুমিল্লা সেনানিবাসের নির্মম বর্বরতার শিকার হয়ে হানাদারদের হাতে শহীদ হতে হয়।
ইতিহাসবিদ প্রফেসর আহসানুল কবীর বলেন- শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য। তিনি আরমা দত্ত হয়েছেন ধীরেন্দ্রনাথের কারণেই। যেহেতু তিনি সরকারের একটি দায়িত্ব শীল পদে আছেন,আপনি চাইলে সরকারের মাধ্যমে বাড়ির জায়গাটি দান করে দিতেপারেন।
যদি অওের্থর সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সরকারের কাছে বিক্রি করে দিতে পারেন।আরমা দত্তকে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানান। নতুন প্রজন্মের কাছে একটি শিক্ষনীয় কিছু রেখে যাওয়ার আহবান জানান। স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী হলো। কিন্তু শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ বাড়িটি অবহেলা, অযত্ন আর ময়লা- আবর্জনার স্তুপে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে আমাদের মানসিক দৈন্যতা ও গুণীজনকে কদর করতে না পারার মানসিকতা। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি রক্ষা পরিষদ,কুমিল্লার সম্বনয়ক বীরমুক্তিযোদ্ধাএড. গোলাম ফারুক বলেন- সরকার ন্যায্য মুল্যে বাড়ির জায়গাটি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবারের কাছথেকে কিনে নিয়ে ,মামলার জটিলতা নিরসনও হয়। এবং বাড়িতে একটি ভাষা যাদুঘর করতে পারে।
কুমিল্লা সিটিকর্পোরেশনের মেয়র আরফানুল হক রিফাত বলেন-শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের পরিবারের কাছে আবেদন করছি। জায়গাটি হস্তান্তর করার জন্য। সিটিকর্পোরেশনও চায় বাড়িটি সংস্কার করে ভাষা ইন্সটিটিউন করতে। এদিকে স্থানীয়রা নাম না প্রকাশে বলছে- কুমিল্লার মনোহরপুরের আফতাফ ব্রাদাসের মালিকের কাছে জায়গাটি বায়না সূত্রে বিক্রি করে দেয়ায় জায়গাটির মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে হাইকোটে।
এবিষয়ে আফতাফ ব্রাদার্সের মালিক বলেন- জায়গাটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় এ বিষয়ে কোন প্রকার বক্তব্য দিতে নারাজ তিনি। কুমিল্লা নজরুল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অশোক বড়ুয়া বলেন- ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পূত্র সঞ্জিব দত্তের কন্যা আরমা দত্ত সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লা শহরের ধর্ম সাগর পাড়ের নিজ বাড়ীতে শেষ কর্মময় জীবন কাটান। ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তথ্য মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিত্যাক্ত বাড়িটিও পরিদর্শন করে ভাষা ইন্সিটিটিউট করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও আইনী জটিলতায় তা আর হয়নি। ১২ বছরেও হয়নি সে জাদুঘর।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী কুমিল্লার নারী সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, এটি আমার দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৈতৃক সম্পত্তি। আসলে আমি তার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। তাঁর বাড়িটি একজন ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রির জন্য বায়না করেছেন নাকি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,না এটি বিক্রি করিনি।
বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে আপনার কোন পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই আমার দাদুর বাড়িটিকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। তার স্মৃতি রক্ষা করব আমরা। কুমিল্লা-৬ সদর আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ভাষা সৈনিক এড ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লার শ্রেষ্ঠ মানুষ ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বীজবপন তিঁনি করেছেন। বাংলা ভাষার জন্য প্রথম দাবি উত্থাপনকারী বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আমরা স্মরণীয় করে রেখেছি। একসময়কার কুমিল্লা স্টেডিয়ামকে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম নামে নামকরণ করেছি। ইতিহাসের এ মহানায়ক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আজ নেই। কিন্তু তাঁর বাংলা ভাষা আজ শুধু রাষ্ট্র ভাষাই নয় আন্তাজার্তিক মাতৃভাষাও বটে।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই বাড়িটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ, তত্ত্বাবধান ও এখানে একটি আন্তজার্তিক মানের ভাষা যাদুঘর স্থাপনের দাবী কুমিল্লার মানুষের দীর্ঘদিনের। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে এ দাবী বাস্তবে রুপ নিবে বলে মনে করেন কুমিল্লাবাসী।
লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক।
পিকে/এসপি